Daily Amar Desh Daily Amar Desh | মতামত

ওসমান হাদি : শহীদের রক্তে থামে না বিপ্লব

প্রকাশিত হয়েছে: ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ
ওসমান হাদি : শহীদের রক্তে থামে না বিপ্লব
ড. মুহাম্মদ আমিনুল হক

ইতিহাস কখনো শূন্যে দাঁড়িয়ে রায় দেয় না। সে তার সিদ্ধান্ত দেয় রক্ত, ত্যাগ ও সংগ্রামের দলিল দেখে। সেই ইতিহাস আজ আবার সাক্ষ্য দিচ্ছেÑবাংলাদেশে আরেকজন ক্ষণজন্মা বিপ্লবীর শাহাদত কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক ধারার অংশ, যেখানে দেখা গেছে যখনই কেউ এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেছেন, তখনই তাকে দমন করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলোÑদমন করে কোনো জাগরণকে থামানো যায় না।

ওসমান হাদি ছিলেন সেই ধারারই একজন উত্তরসূরি। ইনকিলাব মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা এই তরুণ বিপ্লবী সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে গেঁথে থাকা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন। তাঁর লেখনী, বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও রাজপথের আন্দোলন একত্রে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলÑএই দেশ কি চিরকালই লুটপাট, চাঁদাবাজি, মাস্তানি ও পরাধীন রাজনীতির কাছে বন্দি থাকবে?

এই প্রশ্ন তোলাই ছিল তাঁর অপরাধ।

গত শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং সর্বশেষ সিঙ্গাপুরÑসব চিকিৎসা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি শাহাদতবরণ করেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, গুলি কখনো কোনো আদর্শ কিংবা বিপ্লবকে স্তব্ধ করে দিতে পারে না।

বাংলাদেশের ইতিহাসেই এর স্পষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি এই দেশে ইসলামি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে এনেছিলেনÑতিনিও ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চালু করেছিলেন, যেখানে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরে গিয়েছিল জনগণের হাতে। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় শাসনের মাধ্যমে যে গণতন্ত্র কার্যত হত্যা করা হয়েছিল, জিয়াউর রহমান সেই হত্যাকৃত গণতন্ত্রকে পুনর্জীবিত করেন বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ভোটের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মৌলিক নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন স্পষ্ট ও দৃঢ়।

এ কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যু কি তাঁর দর্শনকে শেষ করতে পেরেছিল? পারেনি। বরং জিয়াউর রহমানের শাহাদত বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নকে আরো গভীরভাবে প্রোথিত করেছে।

ওসমান হাদি এই ইতিহাস জানতেন। তিনি শহীদ জিয়াউর রহমানকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং তাঁর রাজনীতি ও দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনিও চেয়েছিলেন এমন একটি বাংলাদেশÑযে বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করবে না, যে বাংলাদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত, যেখানে চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানি ও জুলুমের রাজনীতি থাকবে না। তাঁর কণ্ঠেও নয়া বন্দোবস্ত কোনো স্লোগান ছিল না; ছিল একটি রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের আহ্বান।

মাত্র ৩২ বছরের জীবনে তিনি দেখিয়ে গেছেনÑরাজনীতি মানেই ক্ষমতা নয়, রাজনীতি মানে আদর্শ। কোটি টাকার নির্বাচনি সংস্কৃতির বিপরীতে তিনি শূন্য হাতে মানুষের কাছে গিয়েছেন। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছে, আর তিনি সেই বিশ্বাসের প্রতিটি পয়সার হিসাব জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। রিকশায় চড়ে, পায়ে হেঁটে, ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে নেমে পড়া, সবাইকে কাছে টানা, এই ছিল তাঁর রাজনীতির ভাষা।

টিভি টকশো, রাজনৈতিক মঞ্চ, মিছিল-মিটিংÑসবখানেই তাঁর ঝাঁজালো কণ্ঠস্বর সারা বাংলার মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে, প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। ঘরে ১০ মাসের শিশুসন্তানকে মায়ের কোলে রেখে তিনি অলিগলি চষে বেড়িয়েছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

ওসমান হাদি শুধু কথায় বিশ্বাসী ছিলেন না। ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সেখানে রাজনৈতিক পাঠ হতো নিয়মিত। দেশের গতিপথ কী হবে তা নিয়ে চলত একাডেমিক বিশ্লেষণ। জুলাইকে সংস্কৃতির মধ্যে চর্চায় নিয়ে আসার জন্য চলত কসরত। বাংলাদেশকে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চলত আলাপ-আলোচনা।

২৪ জুলাই বিপ্লবের পর জুলাইয়ের কিছু নেতা ও যোদ্ধা দেশ-বিদেশের নানা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে হোক কিংবা লোভে পড়ে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়ার ধান্ধায় হোক—তারা নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেও একজন ওসমান হাদি বুক টান করে দেশের পক্ষে কথা বলে গেছেন সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। ওসমান হাদিকে কোনো টাকাপয়সা, লোভ-লালসা স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি বলতেন, কাউকে না কাউকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে দেশ রক্ষার জন্য, জুলাইয়ের চেতনা রক্ষার জন্য, নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার জন্য—আমি সেই একজন হয়ে যাই, আমার মরণ হলেও কোনো সমস্যা নেই।

সবসময় শাহাদতের তামান্না বয়ে বেড়াতেন ওসমান হাদি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুদিন আগেও তিনি একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি চাই, আমি কোনো মিছিলের সামনে আছি আর একটি বুলেট আমার জীবনটা কেড়ে নিয়ে আমাকে শহীদ করে দিল।’ তিনি বহুবার বলেছিলেন, আমাকে বুলেট ছাড়া কেউ থামাতে পারবে না। আমি শহীদ হলেও কোনো সমস্যা নেই; আমার খুনির যেন বিচার হয়।

ওসমান হাদির শাহাদতের এই কঠিন তামান্না আল্লাহতায়ালা কবুল করেছেন। তিনি গত ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে ফ্যাসিবাদী হাসিনার দোসর ছাত্রলীগ ক্যাডার ফয়সাল করিম মাসুদ কর্তৃক মোটরসাইকেল থেকে সরাসরি গুলিবিদ্ধ হন। ওসমান হাদি এক জুমাবারে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আর নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আরেক জুমা শুরু হতেই। আল্লাহ তাঁর শাহাদতকে বর্ণিল কায়দায় কবুল করেছেন।

সারা বাংলাদেশ কাঁদছে ওসমান হাদির বিদায়ে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে দল-মত নির্বিশেষে তাঁর পাশে যেভাবে মানুষ দাঁড়িয়েছে, তা নজিরবিহীন। সারা বাংলাদেশের ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী ও জাতীয়তাবাদী শক্তি ওসমান হাদির পাশে দাঁড়িয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারও তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য যা যা করা দরকার, তা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ওসমান হাদিকে জাতীয় বীর ঘোষণা করে ২০ আগস্ট (শনিবার) তাঁর শাহাদতের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি মসজিদ-মন্দিরসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে হাদির জন্য দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ওসমান হাদির স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

আজ ওসমান হাদি নেই। কিন্তু ইতিহাস আবার প্রমাণ করছে—একজন বিপ্লবী মারা গেলে বিপ্লব মরে না। বরং তার রক্ত থেকে জন্ম নেয় অসংখ্য নতুন বিপ্লবী। আজ ওসমান হাদি নেই, কিন্তু ইতোমধ্যেই কোটি কোটি ওসমান হাদি জন্ম নিয়ে ফেলেছে। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখো-কোটি জনতার মধ্যে দ্রোহ ও প্রতিশোধের আগুনের যে স্ফুলিঙ্গ দেখা দিয়েছে, তা অভূতপূর্ব। সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ওসমান হাদির মৃত্যুর প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর জন্য সবার চোখে অশ্রু ঝরছে।

বাংলাদেশ আজ এক বিরাট সংকটকাল অতিক্রম করছে। ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তার দোসররা এক মুহূর্তও বসে নেই। তারা জুলাই বিপ্লবকে মেনে নিতে পারেনি, মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশের নয়া বন্দোবস্তের দিকে যাত্রাকেÑযার সুন্দর সূচনা হবে ১২ ফেব্রুয়ারির গণভোট ও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ফ্যাসিবাদের দোসররা বাংলাদেশকে আগের জাহিলি, পরাধীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চায়। এ জন্য তারা কোনোভাবেই সুস্থ নির্বাচন ও গণভোট হতে দিতে চায় না। ওসমান হাদি তাদের এই অভিপ্রায়ের সামনে এক বিশাল দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি চোখে চোখ রেখে কথা বলে গেছেন। নয়া বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন।

ওসমান হাদির শাহাদত শুধু একটি শাহাদত নয়। তাঁর শাহাদত বাংলাদেশের অস্তিত্বকে হুমকির মুখ থেকে রক্ষা করে গেছে। লাখো-কোটি তরুণ তাঁর শাহাদতে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের জন্য লড়ে যাবেন। রক্তের শেষ বিন্দু থাকা পর্যন্তও আমরা আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে কোনো দেশের কাছে জিম্মি হতে দেব না। বিদেশি কোনো আধিপত্যের কাছে বাংলাদেশ মাথা নত করবে না। সব দেশপ্রেমিক, ইসলামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে একত্র হয়ে হাদির শাহাদতকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে উদযাপন করতে হবে।

হাদিরা মারা যায় কিন্তু তাদের বিপ্লব মরে না।

ওসমান হাদির শাহাদত জিন্দাবাদ।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

ইমেইল : aminulhoque@iiuc.ac.bd