সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার ঘাটতি : মৎস্য উন্নয়নের বাধা
প্রকাশিত হয়েছে: ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০:০০ পূর্বাহ্ণ
জিনিয়া তাবাসসুম
বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই একটি সমুদ্রসম্পদসমৃদ্ধ দেশ। বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশি আমাদের অর্থনীতি, খাদ্যনিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের বড় একটি ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যÑএই বিপুল সম্পদকে আমরা এখনো পুরোপুরি জানতে, বুঝতে এবং বিজ্ঞানের আলোতে কাজে লাগাতে পারিনি। সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার ধারাবাহিক পশ্চাৎপদতা আজ মৎস্য উন্নয়নের পথে এক নীরব অথচ গভীর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমুদ্র গবেষণার প্রথম ঘাটতি দেখা যায় অবকাঠামোয়। পর্যাপ্ত গবেষণা জাহাজের অভাব, আধুনিক হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা, সোনার ও অ্যাকোস্টিক ডিভাইসের অপ্রতুলতা এবং স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণে দুর্বলতাÑসব মিলিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্র গবেষণা এখনো প্রাথমিক ধাপে আটকে আছে। গভীর সমুদ্রে মাছের মজুত নির্ণয়, তলদেশের গঠন বা স্রোত-তাপমাত্রার মৌসুমি পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের মতো মৌলিক বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি বলেই আমাদের কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায়ই অন্ধকারে তীর ছোঁড়ার মতো হয়ে পড়ে। ফলে কোনো অঞ্চলে কোনো প্রজাতির মাছ কত পরিমাণ আছে, কোথায় আহরণ বাড়ানো বা কমানো উচিত এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যায় না।
সমস্যা শুধু প্রযুক্তির অভাবে নয়, মানবসম্পদেও রয়েছে বড় শূন্যতা। সমুদ্রবিজ্ঞানী, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিশেষজ্ঞ এদের সংখ্যা খুবই কম, নিয়মিত গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যা আরো কম। গবেষণার তহবিল না থাকায় অনেক সম্ভাবনাময় গবেষণা শুরু হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন সায়েন্স বিভাগ থাকলেও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা পরিচালনার মতো পরিবেশ বা সুযোগ সীমিত। ফলে সমুদ্রের পরিবর্তনশীল পরিবেশ, প্রজাতির আচরণ, প্রজনন চক্র বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে যে গভীর বিশ্লেষণ দরকার, তা হচ্ছে না।
এছাড়া নিয়মিত স্টক অ্যাসেসমেন্ট না হওয়ায় মাছের প্রজাতিগত অবস্থা সম্পর্কে দেশের তথ্যভান্ডার ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন নৌকা ট্র্যাকিং, স্যাটেলাইট ইমেজিং, ড্রোন মনিটরিং বা জিআইএসের ব্যবহার এখনো সীমিত স্তরে। গবেষণাগারে জিনগত বিশ্লেষণ বা মলিকুলার স্টাডির মতো উন্নত সুবিধাও প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে বহু মূল্যবান প্রজাতি যেমন রূপচাঁদা, লবস্টার, কাঁকড়া বা উচ্চমূল্যের চিংড়ি সুরক্ষার বাইরে থেকে হুমকির মুখে পড়ছে। কোন প্রজাতি কতটা ঝুঁকিতে আছে, তাও নির্ভুলভাবে বলা কঠিন।
এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে মৎস্য খাতে। মাছের মজুতের সঠিক হিসাব না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অতিরিক্ত আহরণের দিকে চলে যাচ্ছি, আবার অনেক ক্ষেত্রেই আমরা জানতেও পারছি না কোথায় নতুন সম্ভাবনা আছে। ছোট আকারের জেলেদের নৌকা থেকে শুরু করে আধুনিক ট্রলারের জন্য নীতি তৈরির ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হয় বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত কিন্তু প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাবে নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই অনুমাননির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে কখনো মাছের প্রজনন মৌসুমে অতিরিক্ত আহরণ ঘটে, কখনো নিষেধাজ্ঞা বাস্তবতায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে মাছের উৎপাদনশীলতা কমে যায়।
বঙ্গোপসাগর ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের চাপের মুখোমুখি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণমাত্রার পরিবর্তন, স্রোতের অনিয়ম, উপকূল ক্ষয় এবং তাপমাত্রার ক্রমবৃদ্ধি মাছের অভিবাসন ও প্রজননে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। কিন্তু এসব পরিবর্তনের মাত্রা, প্রজাতিভেদে এর প্রভাব, কিংবা কোথায় নতুন ‘ডেড জোন’ তৈরি হচ্ছেÑএসব বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা না থাকায় দেশ ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারছে না। দূষণ, বিশেষ করে শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিক ও তেলবাহী জাহাজ দূষণের প্রভাব সম্পর্কেও বিজ্ঞানসম্মত রিপোর্ট খুব কমই তৈরি হয়।
সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো বাংলাদেশ এখনো গভীর সমুদ্রে বাণিজ্যিক মাছ আহরণে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, কারণ গভীর সমুদ্রের ভূতাত্ত্বিক তথা জৈবী তথ্য নেই, মাছের সম্ভাব্য মজুত জানা নেই। এমনকি সার্ভে না হওয়ায় বাণিজ্যিক মাছ আহরণের পরিকল্পনা করা যায় না। পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন ভারত, মিয়ানমারসহ আধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে গভীর সমুদ্র থেকে ক্রমবর্ধমান মজুত আহরণ করছে। কিন্তু যথাযথ গবেষণা ও তথ্য না থাকায় বাংলাদেশ সেখানে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে সুবিশাল একটি সম্পদের দরজা প্রায় অর্ধেক বন্ধই রয়ে যাচ্ছে। নীল অর্থনীতির সম্ভাবনাও স্রেফ নথিপত্রেই আটকে আছে।
আরো একটি বড় দায় হলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও দক্ষতা উন্নয়নের ঘাটতি। বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে যে বিশাল ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা রয়েছে মৎস্য, শামুক-ঝিনুক, সামুদ্রিক শৈবাল, গভীর সমুদ্রের খনিজ, নীল পর্যটন, সমুদ্রভিত্তিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে প্রথম শর্তই হলো সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণাকে শক্তিশালী করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের গবেষণা ল্যাব, জরিপযান, আধুনিক সোনার প্রযুক্তি বা হাইড্রোগ্রাফিক ম্যাপিং ক্ষমতা এখনো অত্যন্ত সীমিত।
এই গবেষণা-অভাবের কারণে মৎস্য উন্নয়ন থেমে যায় অন্ধকারে হাতড়ে চলার মতো। যেমন : বাংলাদেশ এখনো গভীর সমুদ্রের টুনা, স্কুইড বা হাইভ্যালু শেলফিশ আহরণে দক্ষ নয়। প্রতিবেশী দেশগুলো—ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা যেখানে উন্নত সমুদ্র জরিপের মাধ্যমে নতুন মৎস্য প্রজাতির উৎস আবিষ্কার করছে, সেখানে বাংলাদেশ নির্ভর করছে পুরোনো তথ্য, সীমিত জরিপ এবং অনুমানের ওপর। ফল মৎস্য আহরণে উৎপাদনশীলতা কমছে, প্রজাতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে আর ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি ইত্যাদি) সমুদ্র ও মৎস্যবিজ্ঞান পড়ানো হয়। কিন্তু তাদের গবেষণা বাজেট অপ্রতুল, ল্যাব সীমিত আর আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রকাশের হার অত্যন্ত কম। কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষায় যেখানে সাগরভিত্তিক দেশের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল বিপুল বৈজ্ঞানিক দক্ষতা তৈরি।
এ অবস্থায় সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণায় নতুন বিনিয়োগ, নতুন চিন্তা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক গবেষণা জাহাজ, উন্নত ল্যাব, স্যাটেলাইট ও জিআইএস প্রযুক্তির বিস্তার, নিয়মিত স্টক অ্যাসেসমেন্ট, প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ, মৌসুমি নিষেধাজ্ঞার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি এসবকে অগ্রাধিকারে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ডিগ্রি, বিদেশে প্রশিক্ষণ, যৌথ গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। গবেষণার তহবিল বৃদ্ধি ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।
সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। জাপান, নরওয়ে, এফএও, আইওসি-ইউএনইএসসিও এসব সংস্থার সঙ্গে গবেষণা সহযোগিতা বাড়ানো গেলে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ, গবেষণা জাহাজ ও প্রযুক্তি সহজেই পাওয়া যায়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক জার্নালভিত্তিক গবেষণা, যৌথ প্রকল্প ও উন্নত ল্যাব স্থাপনে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের প্রোটিন চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। তাই মৎস্য খাতের টেকসই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আধুনিক, গভীর ও ধারাবাহিক সমুদ্র গবেষণার ওপর। সমুদ্র সম্পর্কে অজ্ঞ থাকলে জাতীয় উন্নয়নও অজ্ঞতার ঘেরাটোপে আটকে থাকবে। সমুদ্রকে জানা মানে আমাদেরই ভবিষ্যৎকে জানা। আর সেই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি আছে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার শক্ত ভিত গড়ে তোলায়।
মৎস্য খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মৌলিক স্তম্ভ। কিন্তু এই খাতের টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়, যদি আমরা সমুদ্র সম্পর্কে অন্ধকারে থেকে যাই। সমুদ্রকে জানা মানে ভবিষ্যৎকে জানা। সুতরাং সময় এসেছে সমুদ্র গবেষণাকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার। যথাযথ পরিকল্পনা, অর্থায়ন, প্রযুক্তি এবং যোগ্য মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের মৎস্য উন্নয়ন, নীল অর্থনীতি এবং জাতীয় সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে নিশ্চিতভাবেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই একটি সমুদ্রসম্পদসমৃদ্ধ দেশ। বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশি আমাদের অর্থনীতি, খাদ্যনিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের বড় একটি ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যÑএই বিপুল সম্পদকে আমরা এখনো পুরোপুরি জানতে, বুঝতে এবং বিজ্ঞানের আলোতে কাজে লাগাতে পারিনি। সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার ধারাবাহিক পশ্চাৎপদতা আজ মৎস্য উন্নয়নের পথে এক নীরব অথচ গভীর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমুদ্র গবেষণার প্রথম ঘাটতি দেখা যায় অবকাঠামোয়। পর্যাপ্ত গবেষণা জাহাজের অভাব, আধুনিক হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা, সোনার ও অ্যাকোস্টিক ডিভাইসের অপ্রতুলতা এবং স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণে দুর্বলতাÑসব মিলিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্র গবেষণা এখনো প্রাথমিক ধাপে আটকে আছে। গভীর সমুদ্রে মাছের মজুত নির্ণয়, তলদেশের গঠন বা স্রোত-তাপমাত্রার মৌসুমি পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের মতো মৌলিক বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি বলেই আমাদের কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায়ই অন্ধকারে তীর ছোঁড়ার মতো হয়ে পড়ে। ফলে কোনো অঞ্চলে কোনো প্রজাতির মাছ কত পরিমাণ আছে, কোথায় আহরণ বাড়ানো বা কমানো উচিত এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যায় না।
সমস্যা শুধু প্রযুক্তির অভাবে নয়, মানবসম্পদেও রয়েছে বড় শূন্যতা। সমুদ্রবিজ্ঞানী, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিশেষজ্ঞ এদের সংখ্যা খুবই কম, নিয়মিত গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যা আরো কম। গবেষণার তহবিল না থাকায় অনেক সম্ভাবনাময় গবেষণা শুরু হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন সায়েন্স বিভাগ থাকলেও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা পরিচালনার মতো পরিবেশ বা সুযোগ সীমিত। ফলে সমুদ্রের পরিবর্তনশীল পরিবেশ, প্রজাতির আচরণ, প্রজনন চক্র বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে যে গভীর বিশ্লেষণ দরকার, তা হচ্ছে না।
এছাড়া নিয়মিত স্টক অ্যাসেসমেন্ট না হওয়ায় মাছের প্রজাতিগত অবস্থা সম্পর্কে দেশের তথ্যভান্ডার ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন নৌকা ট্র্যাকিং, স্যাটেলাইট ইমেজিং, ড্রোন মনিটরিং বা জিআইএসের ব্যবহার এখনো সীমিত স্তরে। গবেষণাগারে জিনগত বিশ্লেষণ বা মলিকুলার স্টাডির মতো উন্নত সুবিধাও প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে বহু মূল্যবান প্রজাতি যেমন রূপচাঁদা, লবস্টার, কাঁকড়া বা উচ্চমূল্যের চিংড়ি সুরক্ষার বাইরে থেকে হুমকির মুখে পড়ছে। কোন প্রজাতি কতটা ঝুঁকিতে আছে, তাও নির্ভুলভাবে বলা কঠিন।
এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে মৎস্য খাতে। মাছের মজুতের সঠিক হিসাব না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অতিরিক্ত আহরণের দিকে চলে যাচ্ছি, আবার অনেক ক্ষেত্রেই আমরা জানতেও পারছি না কোথায় নতুন সম্ভাবনা আছে। ছোট আকারের জেলেদের নৌকা থেকে শুরু করে আধুনিক ট্রলারের জন্য নীতি তৈরির ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হয় বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত কিন্তু প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাবে নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই অনুমাননির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে কখনো মাছের প্রজনন মৌসুমে অতিরিক্ত আহরণ ঘটে, কখনো নিষেধাজ্ঞা বাস্তবতায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে মাছের উৎপাদনশীলতা কমে যায়।
বঙ্গোপসাগর ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের চাপের মুখোমুখি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণমাত্রার পরিবর্তন, স্রোতের অনিয়ম, উপকূল ক্ষয় এবং তাপমাত্রার ক্রমবৃদ্ধি মাছের অভিবাসন ও প্রজননে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। কিন্তু এসব পরিবর্তনের মাত্রা, প্রজাতিভেদে এর প্রভাব, কিংবা কোথায় নতুন ‘ডেড জোন’ তৈরি হচ্ছেÑএসব বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা না থাকায় দেশ ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারছে না। দূষণ, বিশেষ করে শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিক ও তেলবাহী জাহাজ দূষণের প্রভাব সম্পর্কেও বিজ্ঞানসম্মত রিপোর্ট খুব কমই তৈরি হয়।
সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো বাংলাদেশ এখনো গভীর সমুদ্রে বাণিজ্যিক মাছ আহরণে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, কারণ গভীর সমুদ্রের ভূতাত্ত্বিক তথা জৈবী তথ্য নেই, মাছের সম্ভাব্য মজুত জানা নেই। এমনকি সার্ভে না হওয়ায় বাণিজ্যিক মাছ আহরণের পরিকল্পনা করা যায় না। পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন ভারত, মিয়ানমারসহ আধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে গভীর সমুদ্র থেকে ক্রমবর্ধমান মজুত আহরণ করছে। কিন্তু যথাযথ গবেষণা ও তথ্য না থাকায় বাংলাদেশ সেখানে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে সুবিশাল একটি সম্পদের দরজা প্রায় অর্ধেক বন্ধই রয়ে যাচ্ছে। নীল অর্থনীতির সম্ভাবনাও স্রেফ নথিপত্রেই আটকে আছে।
আরো একটি বড় দায় হলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও দক্ষতা উন্নয়নের ঘাটতি। বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে যে বিশাল ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা রয়েছে মৎস্য, শামুক-ঝিনুক, সামুদ্রিক শৈবাল, গভীর সমুদ্রের খনিজ, নীল পর্যটন, সমুদ্রভিত্তিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে প্রথম শর্তই হলো সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণাকে শক্তিশালী করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের গবেষণা ল্যাব, জরিপযান, আধুনিক সোনার প্রযুক্তি বা হাইড্রোগ্রাফিক ম্যাপিং ক্ষমতা এখনো অত্যন্ত সীমিত।
এই গবেষণা-অভাবের কারণে মৎস্য উন্নয়ন থেমে যায় অন্ধকারে হাতড়ে চলার মতো। যেমন : বাংলাদেশ এখনো গভীর সমুদ্রের টুনা, স্কুইড বা হাইভ্যালু শেলফিশ আহরণে দক্ষ নয়। প্রতিবেশী দেশগুলো—ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা যেখানে উন্নত সমুদ্র জরিপের মাধ্যমে নতুন মৎস্য প্রজাতির উৎস আবিষ্কার করছে, সেখানে বাংলাদেশ নির্ভর করছে পুরোনো তথ্য, সীমিত জরিপ এবং অনুমানের ওপর। ফল মৎস্য আহরণে উৎপাদনশীলতা কমছে, প্রজাতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে আর ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি ইত্যাদি) সমুদ্র ও মৎস্যবিজ্ঞান পড়ানো হয়। কিন্তু তাদের গবেষণা বাজেট অপ্রতুল, ল্যাব সীমিত আর আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রকাশের হার অত্যন্ত কম। কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষায় যেখানে সাগরভিত্তিক দেশের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল বিপুল বৈজ্ঞানিক দক্ষতা তৈরি।
এ অবস্থায় সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণায় নতুন বিনিয়োগ, নতুন চিন্তা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক গবেষণা জাহাজ, উন্নত ল্যাব, স্যাটেলাইট ও জিআইএস প্রযুক্তির বিস্তার, নিয়মিত স্টক অ্যাসেসমেন্ট, প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ, মৌসুমি নিষেধাজ্ঞার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি এসবকে অগ্রাধিকারে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ডিগ্রি, বিদেশে প্রশিক্ষণ, যৌথ গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। গবেষণার তহবিল বৃদ্ধি ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।
সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। জাপান, নরওয়ে, এফএও, আইওসি-ইউএনইএসসিও এসব সংস্থার সঙ্গে গবেষণা সহযোগিতা বাড়ানো গেলে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ, গবেষণা জাহাজ ও প্রযুক্তি সহজেই পাওয়া যায়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক জার্নালভিত্তিক গবেষণা, যৌথ প্রকল্প ও উন্নত ল্যাব স্থাপনে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের প্রোটিন চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। তাই মৎস্য খাতের টেকসই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আধুনিক, গভীর ও ধারাবাহিক সমুদ্র গবেষণার ওপর। সমুদ্র সম্পর্কে অজ্ঞ থাকলে জাতীয় উন্নয়নও অজ্ঞতার ঘেরাটোপে আটকে থাকবে। সমুদ্রকে জানা মানে আমাদেরই ভবিষ্যৎকে জানা। আর সেই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি আছে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার শক্ত ভিত গড়ে তোলায়।
মৎস্য খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মৌলিক স্তম্ভ। কিন্তু এই খাতের টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়, যদি আমরা সমুদ্র সম্পর্কে অন্ধকারে থেকে যাই। সমুদ্রকে জানা মানে ভবিষ্যৎকে জানা। সুতরাং সময় এসেছে সমুদ্র গবেষণাকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার। যথাযথ পরিকল্পনা, অর্থায়ন, প্রযুক্তি এবং যোগ্য মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের মৎস্য উন্নয়ন, নীল অর্থনীতি এবং জাতীয় সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে নিশ্চিতভাবেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়