Prothom Alo Prothom Alo | জেলা

২০০ টাকার সুতা দিয়ে শুরু, এখন সাবিহার আয় মাসে ৩০ হাজার টাকা

প্রকাশিত হয়েছে: ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৯:৫০ পূর্বাহ্ণ
২০০ টাকার সুতা দিয়ে শুরু, এখন সাবিহার আয় মাসে ৩০ হাজার টাকা
গ্রামীণ নারীদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়ে সাবিহা খাতুন এখন জয়পুরহাটে অনুপ্রেরণার মুখ। একজন নারী, যিনি নিজে পথ দেখেছেন এবং পথ দেখিয়েছেন শতজনকে। সাধারণ গৃহিণী থেকে সাবিহা এখন সফল নারী উদ্যোক্তা। তাঁর তৈরি হস্তশিল্পের পণ্য যাচ্ছে বিদেশেও।সাবিহার জন্ম জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে। ২০১২ সালে সাবিহার সঙ্গে কালাই পৌরসভার কাজীপাড়ার আবু সুফিয়ান পলাশের বিয়ে হয়। তিনি এক কন্যাসন্তানের মা। জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পড়াশোনা ও সংসারের পাশাপাশি তাঁর মনে ছিল গ্রামের নারীদের নিয়ে কিছু করার তাগিদ। বিশেষ করে যাঁরা অবসর সময়ে ঘরে বসে থাকেন, তাঁদের আয়মুখী কাজে যুক্ত করার ইচ্ছা থেকেই তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না। করোনার বিধিনিষেধে যখন সবাই ঘরবন্দী ছিলেন, সেই সময় তাঁর স্বপ্ন ধরা দেয়।

সাবিহা খাতুন জানান, তাঁর মা ছিলেন দক্ষ হস্তশিল্পী। তিনি তাঁর কাছ থেকেই হস্তশিল্পের কাজ শিখেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) থেকেও  প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তবে সময় ও সুযোগের অভাবে কাজ শুরু করতে পারেননি সাবিহা। করোনার সময় বাড়িতে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি। তখন নিজের সন্তানের জন্য শীতের একটি জামা বানান। এটি দেখে প্রতিবেশীরাও তাঁকে জামা বানানোর অর্ডার দেন। তিনি ২০০ টাকা দিয়ে সুতা ও উপকরণ কিনে বাচ্চাদের শীতের জামা বানান।তখন গ্রামের পাঁচ নারী সাবিহার কাছ থেকে হস্তশিল্পের কাজ শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁদেরও কাজ শেখান সাবিহা। অল্প দিনে তাঁরাও দক্ষ হয়ে যান। সাবিহা মুঠোফোনে হস্তশিল্পের বিভিন্ন পণ্য দেখে সেসব তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজেসহ গ্রামের পাঁচ নারী মিলে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে সাবিহা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হন। ‘সোহা হস্তশিল্প’ নামে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন। সোহা তাঁর মেয়ের নাম। এই পেজ থেকে অর্ডার পেয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পণ্য পাঠাতে শুরু করেন সাবিহা। প্রথম মাসেই ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। তাঁরা সবাই এই টাকা নিজেদের মধ্য ভাগ করে নেন। এতে তাঁদের কাজের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। সঙ্গে আরও বেকার নারী যোগ দেন।এগিয়ে যেতে থাকেন সাবিহা। বর্তমানে জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি ও কালাইয়ে মোট আটটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন তিনি। এসব কেন্দ্র নারীদের হস্তশিল্পের কাজ শেখানো হয়। কেন্দ্রে সেসব নারী কর্মীর কাছে উপকরণ পাঠিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য বানিয়ে নেন সাবিহা। কেন্দ্রগুলোতে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থীও রয়েছেন। তাঁরা পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে কাজ করে আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।

 রাজিয়া আক্তারের বাসা পাঁচবিবি উপজেলায়। তিনি জয়পুরহাট সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি সময় পেলে কাজ করি। আয় দিয়ে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাই।’সাবিহার অধীন নারীরা শীতের চাদর, পঞ্চ, টুপি, বেবি নেট, টেবিলম্যাট, টিস্যুবক্সের কভার, ব্যাগসহ হস্তশিল্পের ৩২ ধরনের পণ্য তৈরি করছেন। এসব পণ্য এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় যাচ্ছে বলে জানায় বিসিক জয়পুরহাট। সাবিহা খাতুন বলেন, ‘২০০ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার পাঁচ লক্ষাধিক টাকার মালামাল রয়েছে। মাসে অন্তত আড়াই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার শীতের টুপির অর্ডার পেয়েছি। সেগুলো তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছি।’ সম্প্রতি সাবিহা খাতুনের জয়পুরহাট শহরের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী নারী উলের সুতা ও ক্রুশ কাঁটা দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি করছেন। শীতের চাদর, পঞ্চ, টুপি, বেবি নেট, টেবিলম্যাট, টিস্যুবক্সের কভার, ব্যাগ বানাচ্ছেন। গৃহিণীদের পাশাপাশি অনেক ছাত্রীও কাজ করছিলেন। সাবিহা তাঁদের কাজের তদারকি করছিলেন।সাবিহা খাতুনের স্বামী আবু সুফিয়ান (পলাশ) জয়পুরহাট শহরের আমতলী এলাকায় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করেন। তিনি স্ত্রীর হস্তশিল্পের কাজে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছেন। আবু সুফিয়ান বলেন, ‘সাবিহার উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছিল। এ কারণে  সফল হয়েছে সে। প্রতিটি কাজেই সহযোগিতা করে আসছি। সাবিহার কারণে অনেক বেকার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এসব নারী যখন টাকা নিয়ে খুশি হয়ে বাড়িতে যান, তখন নিজের কাছে অনেক ভালো লাগে।’  কালাইয়ের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা রত্না আখতার। কৃষিকাজ করে স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। সাবিহার সঙ্গে কাজ করে রত্নার এখন মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আয় হয়। নিজে স্বাবলম্বী হতে পেরে বেশ খুশি রত্না।

জয়পুরহাট শহরের আমতলী মহল্লার বাসিন্দা জান্নাতুন খাতুন বলেন, ‘আমি সাবিহা আপার কাছ থেকে হস্তশিল্পের কাজ শিখেছি। প্রায় চার বছর ধরে কাজ করছি। প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা রোজগার করি। এই টাকা আমার পরিবারের ব্যয়ভার বহনে বড় ভূমিকা রাখে।’জয়পুরহাট বিসিকের উপব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ জানান, বিসিক থেকে সাবিহা খাতুন প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তিনি জেলার একজন সফল উদ্যোক্তা। সাবিহার হাত ধরে গ্রামের দুই শতাধিক নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন। সাবিহার হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানিও হচ্ছে।সাবিহা খাতুনকে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে উল্লেখ করে কালাই উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুন বলেন, সাবিহা গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করেছেন। সাবিহার হস্তশিল্প পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। তাঁকে ‘জয়িতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে।