Daily Amar Desh Daily Amar Desh | সারা দেশ

ধর্মের মুখোশে ময়মনসিংহে দিপু দাসকে পরিকল্পিত হত্যা

প্রকাশিত হয়েছে: ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ
ধর্মের মুখোশে ময়মনসিংহে দিপু দাসকে পরিকল্পিত হত্যা
আব্দুল কাইয়ুম, ময়মনসিংহ

ব্যক্তিগত বিরোধ ও শ্রমিক অধিকার আন্দোলনকে ধর্মীয় উসকানির রূপ দিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাসকে (২৭) হত্যা করা হয়েছে। ওই যুবকের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী ও অনুসন্ধান সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দিপু ময়মনসিংহের জামিরদিয়া ডুবালিয়াপাড়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেডের শ্রমিক ছিলেন। তিনি তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে।

পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী এটি হঠাৎ কোনো উত্তেজিত জনতার ঘটনা নয়; বরং পরিকল্পিতভাবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তৈরি করে দিপুকে হত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর নিহতের ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় অন্তত ১৫০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ইতোমধ্যে র‌্যাব-১৪ ও জেলা পুলিশের যৌথ অভিযানে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা করেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দিপু চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ধরে কারখানায় শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। উৎপাদন বাড়ানো, ওভারটাইম, কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন। এতে মালিকপক্ষের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ কারণেই তাকে দীর্ঘদিন পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। একপর্যায়ে কারখানা থেকে বের করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

নিহতের পরিবার জানায়, গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে দিপুকে জোরপূর্বক চাকরি ছাড়তে চাপ দেওয়া হয়। এতে রাজি না হওয়ায় তাকে ধর্ম অবমাননার ঘটনায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। পরে ওই হুমকিই বাস্তবায়ন করা হয়।

জানা গেছে, ঘটনার দিন কারখানার ভেতরে দিপুকে হুমকি ও মারধর করা হয়। এরপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি চক্র বাইরে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা লোকজনকে খবর দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কারখানার সামনে স্লোগান ও বিক্ষোভ শুরু হয়।

সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, এ পরিস্থিতিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ থানা পুলিশকে অবহিত না করে মূল গেট খুলে দেয় এবং দিপু চন্দ্র দাসকে তথাকথিত বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে তুলে দেয়। এরপর একদল লোক তাকে পিটিয়ে হত্যা করে এবং লাশ গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেয়।

ঘটনার পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখা হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং অর্ধদগ্ধ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

পরে সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, যাদের ‘বিক্ষুব্ধ মুসলিম জনতা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাদের কেউই ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসিন্দা নন।

র‌্যাব-১৪-এর অভিযানে গ্রেপ্তারদের মধ্যে রয়েছেনÑমাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আলমগীর হোসেন (৩৮), ঝালকাঠির পোনাবালিয়া গ্রামের মিরাজ হোসেন আকন (৪৬), গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার তারেক হোসেন (১৯) ও এরশাদ আলী (৩৯), কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার লিমন সরকার (১৯) এবং সুনামগঞ্জের ধোয়ারা গ্রামের নিজুম উদ্দিন (২০)।

অপরদিকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার আজমল হাসান সগীর (২৬) ও শাহিন মিয়া (১৯) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাজমুলকে (২১)। গ্রেপ্তারের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যুক্তদের বড় অংশই ময়মনসিংহের বাইরের জেলা থেকে আগত।

নিহতের বোন চম্পা দাস বলেন, আমার ভাই বিএ পাস। সে সাধারণ বাটন মোবাইল ব্যবহার করত। ধর্ম নিয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। নবীকে নিয়ে কটূক্তি করার মতো মানুষ সে নয়। উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে বিরোধ ছিল। সে কারণেই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

নিহতের বাবা রবি চন্দ্র দাস বলেন, ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ থাকলে দেশে আইন আছে। আদালতে বিচার হতো।

নিহতের স্ত্রী মেঘনা রানী বলেন, আমার একমাত্র সন্তান আজ বাবাহারা। এ হত্যার বিচার চাই।

কী বলছে রাজনৈতিক মহল

ভালুকা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে দলটির এমপি প্রার্থী ফখর উদ্দিন আহমেদ বাচ্চু বলেন, এত দ্রুত শতাধিক লোক সংগঠিত হওয়া স্বাভাবিক নয়। এখানে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। ধর্ম অবমাননার ইস্যু ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল ও আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত করতেই কোনো মহল এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলা জামায়াতের আমির আব্দুল করিম বলেন, ঘটনাটিতে ষড়যন্ত্রের আভাস স্পষ্ট। দেশকে অস্থিতিশীল করতে ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া সত্য বের হবে না।

আওয়ামী-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ

পাইওনিয়ার নিটওয়্যারসের মালিক বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদশা মিয়া। স্থানীয়দের অভিযোগ, শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি ভালুকায় একরের পর একর বনভূমি দখল করে শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। স্থানীয়দের মতে, বাদশা মিয়া দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এমনকি বাদশা মিয়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং একেএম শহীদুল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। শ্রমিক অধিকার আন্দোলন দমন, শিল্পস্বার্থ রক্ষা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির বৃহত্তর ছকের অংশ হিসেবেই দিপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে।