Prothom Alo Prothom Alo | পাকিস্তান

কারাবন্দী ইমরান খান কি পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ‘বরপুত্র’

প্রকাশিত হয়েছে: ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৮:০০ পূর্বাহ্ণ
কারাবন্দী ইমরান খান কি পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ‘বরপুত্র’
অদ্ভুতভাবে ইমরান খান এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে আদিয়ালা কারাগারের ৮০৪ নম্বর কয়েদি ইমরান খানের জনপ্রিয়তা তো কমেনি; বরং তিনি এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যে ব্যবস্থাটিকে বহু মানুষ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করে।ইমরান খান যে কারাগারে আছেন, সেখানে ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। তখন নাম ছিল পুরোনো রাওয়ালপিন্ডি জেল। কেবল ইমরান বা ভুট্টো একা নন, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফসহ বহু রাজনীতিকের ঠাঁই হয়েছিল ওই কারাগারে।সম্প্রতি খবর ছড়িয়ে পড়ে, ইমরান কারাগারে ইন্তেকাল করেছেন। এমন খবরে বিচলিত হয়ে পড়েন যুক্তরাজ্যে থাকা তাঁর ছেলে সুলাইমান খান, কাসিম খানসহ পরিবারের সদস্যরা। তবে খবরটি সঠিক নয়। ইমরান বেঁচে আছেন, তবে তাঁকে এমন প্রকোষ্ঠে একাকী রাখা হয়েছে, যেখানে ফাঁসির আসামিদের রাখা হয়।চলতি বছর ইমরান খানের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। জানুয়ারিতে আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর শনিবার তাঁকে দুর্নীতির মামলায় ইমরান ও তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবিকে ১৭ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। আদিয়ালা জেলে পরিবার ও আইনজীবীদের সাক্ষাতে বাধা এবং সর্বোচ্চ অমানবিক পরিস্থিতির কারণে ডিসেম্বরে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ এটিকে ‘মানসিক নির্যাতন’ বলে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের সমর্থকেরা প্রতিবাদ করে তাঁর মুক্তি দাবি করলেও কোনো বড় সাফল্য বা মুক্তি ছাড়াই বছর শেষ হতে চলেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আপাতত ইমরানের রাজনীতির ময়দানে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নেই। কারণ, নির্বাচনী প্রতীক হারিয়ে ইমরানের দল পিটিআই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দলীয় কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁদের একপ্রকার চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ রয়েছে সভা-সমাবেশ। আবার দলের মধ্যেও রয়েছে নানা মত।তবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, একজন সাহসী, উচ্চকণ্ঠের রাজনীতিবিদ হিসেবে ইমরানের জনপ্রিয়তা অটুট রয়েছে। পিটিআই যতই দমন-পীড়নের শিকার হোক, শহুরে তরুণ ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী; বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ার তরুণেরা এখনো মনে করেন, পিটিআই তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য লড়ছে।

ইমরান খানের সঙ্গে একাধিক ব্যক্তিগত আলাপচারিতার স্মৃতি আছে ভারতের কংগ্রেসদলীয় রাজনীতিবিদ ও লেখক শশী থারুরের। অতি সম্প্রতি এক লেখায় তিনি ইমরান খান সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ক্রিকেট, রাজনীতি বা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক—সব বিষয়ে তিনি স্পষ্টভাষী, তর্কপ্রবণ এবং চ্যালেঞ্জ জানাতে আগ্রহী। দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যেও তিনি ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁর ক্রীড়া-উত্তরাধিকার আর ব্যক্তিগত ভদ্রতা তাঁকে মানুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।শশী থারুর আরও লিখেছেন, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও ইমরান একজন চিন্তাশীল মানুষ। উপমহাদেশের যৌথ ইতিহাস বিষয়ে তিনি গভীর আগ্রহ ও আবেগ পোষণ করেন।এ লেখায় আমরা রাজনীতিবিদ ইমরান ও ব্যক্তি ইমরানের মনস্তত্ত্ব ও দর্শন বোঝার চেষ্টা করব। একই সঙ্গে আলোচনা করব তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও।

নেতৃত্ব শেখাল অক্সফোর্ডলাহোরে ১৯৫২ সালে এক সম্ভ্রান্ত পশতুন পরিবারে জন্ম নেওয়া ইমরান খান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে। ইমরানের যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, এর পেছনে ভূমিকা ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরও। সেখানে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কাউন্টি ক্রিকেটে খেলে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। অক্সফোর্ডের অধিনায়কত্ব ছিল নেতৃত্বে তাঁর প্রথম পাঠ।ক্রিকেটার হিসেবে ইমরানের উত্থান শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে। অনেকেই হয়তো জানেন ইমরানের মায়ের বংশধারায় ছিল ক্রিকেটের বীজ। ইমরানের চূড়ান্ত সাফল্য আসে ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক জয়ের মধ্য দিয়ে। তাঁর নীতি ছিল সরল, ফর্মের তুঙ্গে থেকেই অবসর নেবেন। সেই ভাবনায় ১৯৮৭ সালে অবসরও নেন। কিন্তু জনতার ভালোবাসা তাঁকে ফিরিয়ে আনে।আত্মজীবনী ‘অলরাউন্ড ভিউ’–এ ইমরান লিখেছেন, ‘লোকজন আমার বাসার সামনে বসে থাকত। কেউ কেউ অনশনের হুমকি দিত। চিঠির বাক্স ভরে যেত, ফোন থামত না। সবচেয়ে বেশি চাপ আসত দল থেকেই…।’ শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক।

অধিনায়ক হিসেবে ইমরান কৌশলগত দীক্ষা, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব এবং ভেতরে ভাঙন ধরা দলকে একত্র করার সক্ষমতার জন্য প্রশংসিত ছিলেন। ইংল্যান্ড সফরকালে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে বিব্রতবোধ করতেন। ইমরান এসব মানসিক বাধা থেকে ক্রিকেটারদের মুক্ত করেছিলেন। সাবেক ক্রিকেটার আকিব জাভেদ একবার বলেছিলেন, ইমরানের ক্ষেত্রে ‘লিডার’ লেখার সময় ‘এল’ অক্ষরটা বড় করে লিখতে হয়।ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর ইমরান খান মানবসেবায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন শওকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল। এটি পাকিস্তানের প্রথম এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজারো মানুষ বিনা মূল্যে চিকিৎসা পেয়েছে। শওকত খানুম এখন পাকিস্তানের সেরা ক্যানসার হাসপাতাল। লাহোর ও পেশোয়ারে দুটি শাখা, আর ৭৫ শতাংশ রোগী বিনা মূল্যে চিকিৎসা পান।এই হাসপাতাল গড়ে ওঠে মূলত সাধারণ মানুষের অনুদানে। এটি ইমরানের জনপ্রিয়তা ও মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগের প্রমাণ দেয়।

তিন স্লোগান নিয়ে রাজনীতিপাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতালেন, মায়ের নামে হাসপাতাল চালু হলো।ইমরান খানের বয়স তখন ৪৪। তিনি মনে করলেন, মানুষের জন্য কাজ করার সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা রাজনীতি। অনেক বছর ধরেই বিষয়টি তিনি ভাবছিলেন। সেই চিন্তা থেকে ১৯৯৬ সালে তিনি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দল গঠন করেন।শুরুতে দলটি রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি। কিন্তু ২০১০ সালের পর হঠাৎ করেই এর উত্থান ঘটে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) তখন ক্ষমতায়, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইউসুফ রাজা গিলানি। দুর্নীতিবিরোধিতা, জাতীয় মর্যাদা এবং ইসলামি কল্যাণরাষ্ট্র—এই তিন মূল স্লোগান ছিল তাঁর।রাজতন্ত্রসুলভ রাজনীতি ও সামরিক হস্তক্ষেপে বিরক্ত নতুন প্রজন্মের মধ্যে এসব কথা গভীর প্রভাব ফেলে।২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ইমরানের পিটিআইয়ের নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতায় আসে এবং ইমরান প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

কিন্তু ইমরানের শাসনামল ছিল অর্থনৈতিক সংকট, কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠানের সর্বদা উপস্থিত ছায়ার সঙ্গে এক কঠিন লড়াইয়ে পরিপূর্ণ। এই ‘ডিপ স্টেট’ শেষ পর্যন্ত তাঁর পথচলাকেই থামিয়ে দেয়।রাজনৈতিক দল শুরুর প্রথম দিকের দিনগুলোতে ইমরান তাঁর অনুসারীদের বুঝিয়েছিলেন, সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে দরকার চারটি বড় শহরে মাত্র ২০ হাজার মানুষকে রাস্তায় নামানো। এতে জেনারেলরা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারবেন না। কিন্তু পরে ইমরান বুঝলেন, পাকিস্তানে ক্ষমতায় যেতে সেনা সদরের দরজা পেরোতেই হবে।একসময় ওই জেনারেলরাই ইমরানের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বিভিন্নভাবে তাঁকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেন, এটা সত্য। এর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করা থেকে শুরু করে তাঁদের কারাগারে পাঠানো পর্যন্ত—সবই করা হয়েছিল।

কেন পতন হলো ইমরান খানেরইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দুই বছর ছিল উচ্চ প্রত্যাশা ও কঠিন বাস্তবতার সংঘর্ষের সময়। ক্ষমতায় এসেই তিনি দুর্নীতিবিরোধী শাসন ও ‘নতুন পাকিস্তান’-এর স্বপ্ন দেখান। কিন্তু অর্থনীতিতে বড় সংকট দ্রুত সামনে আসে।পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়, আইএমএফের সঙ্গে ঋণচুক্তি করতে হয়, টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে এবং নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ তৈরি করে এবং সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেয়।অন্যদিকে পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু সাফল্য থাকলেও শাসন ও প্রশাসনে দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক মহলে জোরালোভাবে তুলে ধরা এবং আফগান শান্তিপ্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে ঘন ঘন মন্ত্রিসভা পরিবর্তন, অর্থমন্ত্রী বদল এবং সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ সরকারকে দুর্বল করে।

দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিরোধী দলগুলো বেশি লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় প্রতিহিংসার অভিযোগ ওঠে। সব মিলিয়ে এই সময়টা ছিল নৈতিক বক্তব্যে শক্তিশালী, কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর শাসনে সীমাবদ্ধতার প্রতিচ্ছবি।ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠন করে। বছর দেড়েকের মাথায় এই পিডিএম পার্লামেন্টে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব তোলে। দলীয় কিছু নেতা বিরোধী শিবিরে হাত মেলালে ওই ভোটে হেরে যান তিনি। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত ১২টা ছোঁয়ার পরপরই ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ হয়ে যায়।

‘ডিপ স্টেট’–এর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতএর আগে ২০২২ সালের ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি ইমরান খান রাশিয়া সফর করেন, যা ছিল ২৩ বছর পর কোনো পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফর। ইমরান খান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সফরের সময় পাকিস্তান রাশিয়া থেকে সস্তা গম ও গ্যাস কেনার চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে।তবে সফরের সময়টি অত্যন্ত বিতর্কিত হয়ে ওঠে; কারণ, ঠিক ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করে। ইমরান খান মস্কোতে থাকাকালেই এই আক্রমণের ঘটনা ঘটে, যা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক নিন্দা কুড়ায়।পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইমরানের সফরটিকে রাশিয়ার প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখে এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া এই সফর থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন এবং রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা করেন।যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে স্পষ্টভাবে জানায়, ইমরানের নিরপেক্ষতা (রাশিয়ার নিন্দা না করা) তাদের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। একটি ফাঁস হওয়া ডিপ্লোমেটিক কেব্‌ল (সাইফার) অনুসারে, ২০২২ সালের ৭ মার্চ ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু বলেন, যদি অনাস্থা ভোটে ইমরান সরে যান, তাহলে সব ক্ষমা করে দেওয়া হবে; অন্যথায় পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

এই সফরকে অনেকে ইমরানের ক্ষমতাচ্যুতির একটি প্রধান কারণ হিসেবে দেখেন। মাত্র এক মাস পর (এপ্রিল ২০২২) জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটে তিনি ক্ষমতা হারান। ইমরান এবং তাঁর সমর্থকেরা দাবি করেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘রেজিম চেঞ্জ’ ষড়যন্ত্র এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগ অস্বীকার করে। তারা বলে, তারা শুধু সফরের বিরোধিতা করেছে।

ইমরান খান তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অভিযুক্ত করে সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন। পাকিস্তানের ডিপ স্টেটের সঙ্গে তিনি মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।ক্ষমতা হারানোর পর ইমরান খানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার এবং একঘরে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০২৩ সালের আগস্টে তিনি গ্রেপ্তারের পর কারাগারে যান। একাধিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন। ইতিমধ্যে তাঁর ১৪ বছরের সাজা হয়েছে। নতুন করে ২০ ডিসেম্বর শনিবার আরেক মামলায় আরও ১৭ বছরের কারাদণ্ড হলো তাঁর।এখানেই শেষ নয়। ইমরানের বিরুদ্ধে আরও ১৫০টির বেশি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় উপহার চুরি করা থেকে শুরু করে সেনা সদর দপ্তরে সহিংস হামলায় উসকানি দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব মামলায় দোষী হলে তাঁকে বহু বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। পরিস্থিতির আচমকা কোনো পরিবর্তন না হলে হয়তো বাকি জীবন কারাগারে থাকতে হবে ইমরানকে।

ইমরান এখন ‘কাসিমের বাবা’সেনাবাহিনী ও সরকার এখন চেষ্টা করছে ইমরান খানকে টেলিভিশনের খবর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, জনগণের স্মৃতি—সব জায়গা থেকে মুছে ফেলতে। এমনকি তাঁর নাম নেওয়াও নিষেধ। কিছু টেলিভিশন চ্যানেল তাঁকে ‘কাসিমের বাবা’ বলে উল্লেখ করে।গত জুনে যখন ইমরানের দুই ছেলে পাকিস্তানে এসে বাবার মুক্তির আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁদের গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়। এখন আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও পরিবার ও আইনজীবীদের সঙ্গে ইমরান খানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।সমর্থকেরা এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। বার্সেলোনা ও লন্ডনে তাঁদের অবস্থান কর্মসূচিও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সমর্থকেরা কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তাঁর মুক্তির জন্য তদবির করছেন; কিন্তু তা বেশ কঠিন। কারণ, ট্রাম্প সম্প্রতি পাকিস্তানের চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস আসিম মুনিরকে ‘আমার সবচেয়ে প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

পাকিস্তানে রাজনীতিবিদদের পরিণতিযাঁরা পাকিস্তানের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন, তাঁরা জানেন গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে অনেককেই কোনো না কোনো সময় কারাভোগ করতে হয়েছে। এটা যেন পদটিরই অংশ। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৯ সালে হত্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।৪৫ বছর পর ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানান, জুলিফকার আলী ভুট্টোর ফাঁসির রায় ছিল সম্ভবত ন্যায়বিচারের ঘাটতির ফল।

ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের পর পাকিস্তানের সব প্রধানমন্ত্রীই শেষ পর্যন্ত কারাগার থেকে জীবিত বেরিয়ে এসেছেন। কেউ কেউ আবার ক্ষমতায়ও ফিরেছেন। এর নিয়মটা সহজ। একসময় তাঁরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করেন, দেশ ছাড়েন এবং সময়ের অপেক্ষা করেন।সেনাবাহিনীরও আছে একটি ‘প্লেবুক’ অর্থাৎ কীভাবে, কোন পরিস্থিতি সামলাতে হবে, সেই কৌশল। যেসব প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ক্ষমতা আছে বলে সত্যি ভাবতে শুরু করেন, পূর্বনির্ধারিত কৌশলে তাঁদের সামাল দেওয়া হয়। রাজনীতিবিদদেরও আছে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার নিজস্ব নানা পথ।

পেছনে নতুন ‘সুলতান’ইমরানের দলকে দমন করে রাখার পেছনে কামার জাভেদ বাজওয়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাকিস্তানের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থপতি এই নতুন ‘সুলতানই’। ইমরানের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান কঠোর।অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে আসিম মুনিরের দৃষ্টিভঙ্গি কঠিন। পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতি—সবকিছু একাই নিয়ন্ত্রণ করেন। সব মিলিয়ে নতুন একধরনের সামরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছেন আসিম মুনির, যাকে অনেকেই বলছেন ‘মুনিরবাদ’।বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক আগে থেকেই সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকে ছিল। মুনির সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকাপোক্ত করেছেন। শাহবাজ শরিফ এমন এক ম্যান্ডেটে সরকার চালাচ্ছেন, যা জনগণের উচ্ছ্বাস থেকে নয়; বরং সেনাবাহিনীর কৌশলগত প্রয়োজন থেকে এসেছে। তিনি নির্বাচিত নেতার মুখোশ পরে বাস্তবে সেনাপ্রধানের নির্দেশনায় হাঁটছেন।

তবে কি ইমরানের ক্যারিয়ার শেষইমরান খানের উত্তরাধিকার জটিল। তিনি একাধারে জাতীয় নায়ক, বৈশ্বিক আইকন, সংস্কারের পক্ষের নেতা এবং একজন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন, অনেককেই হতাশ করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথা নত করেননি। তাঁর জীবন উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাক্ষ্য দেয়—খেলায়, ব্যক্তিজীবনে, রাষ্ট্রে, রাজনীতিতে।দুই বছর কারাগারে থেকেও ৭৩ বছর বয়সী ইমরান এখনো দমে যাননি। তিনি পাকিস্তানের সবচেয়ে জোরালো বিরোধী কণ্ঠ। সমর্থকদের কাছে তিনি পাকিস্তানের ‘গণতন্ত্রের সূর্যসন্তান’। যেহেতু তিনি রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার সেনাবাহিনীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে ক্ষমতার জন্য লড়েছেন।একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিবার বা পুরোনো রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির বাইরে থেকে সাধারণ ভোটার ও মিডিয়া সমর্থনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর তিনি একপ্রকার জনপ্রিয়তা ও গণতান্ত্রিক সমর্থনের প্রতীক হয়ে ওঠেন।ইমরান খান কেবল একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি নন, তিনি একটি আন্দোলনের নাম। তাই এখনো স্বপ্ন দেখেন, কারাগারের এই দিন শেষ হবে। আবার ফিরবেন ২৪ কোটি মানুষের দেশটির নেতৃত্বে। ন্যায়বিচার, সবার জন্য সমান সুযোগ আর সাম্যই হবে সেই নেতৃত্বের দর্শন।ই-মেইল: [email protected]তথ্যসূত্র: ডন, টাইম, ডিডব্লিউ, গার্ডিয়ান, প্রথম আলোসহ একাধিক সংবাদমাধ্যম