Daily Ittefaq
|
মতামত
ডলার-নির্ভরতা হ্রাসের চেষ্টা বিশ্ব অর্থনীতির নতুন গতিপথ
প্রকাশিত হয়েছে: ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৯:৪৭ অপরাহ্ণ
বিশ্বব্যাপী আ শ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় সব লেনদেনই করা হয় ইউএস ডলারের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম এটা আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে ডলারকে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সে সময় থেকে প্রতিটি দেশ তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে মার্কিন ডলার সংরক্ষণ করতে শুরু করে। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনে এককভাবে ইউএস ডলার ব্যবহারের এই নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বিভিন্ন দেশ। তারা বৈদেশিক লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব মুদ্রা বা ভিন্ন কোনো মুদ্রা ব্যবহার করার দাবি তোলে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ভিন্ন কোনো মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলার এই ধারণাটিই হল ডি-ডলারাইজেশন। 'ডি-ডলারাইজেশন' শব্দটি নতুন মনে হতে পারে, তবে দেশগুলো কয়েক দশক ধরে ইউএস ডলারের উপর নির্ভরতা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। চীন, রাশিয়া, ব্রাজিলও এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যারা ডি-ডলারাইজেশনকে চাইছে। এই বছরের জানুয়ারিতে তারা ঘোষণা করেছিল, ইরান এবং রাশিয়া যৌথ ভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি হিসাবে স্বর্ণভিত্তিক একটি নতুন কারেন্সি চালু করবে। ডলারের প্রাধান্যকে সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হলেও আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য সর্বাধিক স্বীকৃত ও বহুলপ্রচলিত মুদ্রা হলো ইউএস ডলার। মূলত ১৯২০-এর দশকে ডলার, পাউন্ড ও স্টার্লিংকে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে। ব্রেটন উডস চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডলারের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, ১৯৪৪ সালের চুক্তিটি এমন একটি যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা ইউএস ডলারকে বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত করার অনুমতি দেয়।
কিন্তু ডলারের বিশ্বায়নের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী বাণিজ্যনীতি। এর বিপরীতে পালটা ব্যবস্থার দিকে হাঁটছে দেশটির অনেক বাণিজ্য অংশীদার, যার প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের অবস্থানে। আনাদোলুর এক প্রতিবেদন অনুসারে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি বৈশ্বিক প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এছাড়া বিকল্প বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ডি-ডলারাইজেশন বা ডলার-নির্ভরতা হ্রাসের চেষ্টা বাড়ছে।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) ইউএস ডলার সূচক ১১ শতাংশের বেশি কমে ৯৭-এ দাঁড়িয়েছে, যা ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স। গত ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাপকভাবে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের ঘোষণা দেন। এর পর থেকেই ডলার সূচক ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যে খণ্ডিত অবস্থা এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীদের ডলার থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করছে। এর বিপরীতে স্বর্ণ মজুতের পাশাপাশি ইউরো ও ইউয়ানের মতো বিকল্প মুদ্রার দিকে ঝুঁকছে তারা। ডলারের ওঠানামার সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজস্ব মুদ্রার মান পেগ বা স্থির করে রেখেছে চীন। এর ফলে ইউয়ানের বিনিময় হার অতিরিক্ত বাড়ে বা কমে না, যা রপ্তানিকারকদের জন্য অনুকূল। এতে ইউরোপসহ প্রধান বাজারে চীনা রপ্তানি মূল্য প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে। যে কারণে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশ চীনা পণ্য সস্তায় কিনতে পারে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জোট ব্রিকস সম্প্রতি ডলার-বহির্ভূত লেনদেনের উদ্যোগকে আরো গতিশীল করেছে। গবেষণা সংস্থা অফিশিয়াল মনিটারি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ফোরামের (ওএমএফআইএফ) এক জরিপ অনুসারে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যাংকগুলোর ১৬ শতাংশ ১২-২৪ মাসের মধ্যে ইউরোর মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। ৩২ শতাংশ বলেছে, তারা স্বর্ণের মজুত বাড়াতে চায়।বর্তমানে মার্কিন সরকারি ঋণ ৩৭ ট্রিলিয়ন বা ৩৭ লাখ কোটি ডলার, যা চলতি দশকের শেষ নাগাদ ৪৭ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে সরকারি কর রাজস্বের প্রায় ২০ শতাংশই এখন সুদ পরিশোধে ব্যয় ডলারের ওঠানামার সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজস্ব মুদ্রার মান পেগ বা স্থির করে রেখেছে চীন। এর ফলে ইউয়ানের বিনিময় হার অতিরিক্ত বাড়ে বা কমে না, যা রপ্তানিকারকদের জন্য অনুকূল। এতে ইউরোপসহ প্রধান বাজারে চীনা রপ্তানি মূল্য প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে হচ্ছে, যা মার্কিন বন্ডবাজার এবং ডলারের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গৃহীত হচ্ছে, যার মাধ্যমে ডলার-সমর্থিত স্টেবলকয়েন সারা বিশ্বে সহজলভ্য হবে। একে মার্কিন ঋণ ব্যবস্থাপনা সহজ করতে একটি দ্রুত ও বাস্তবমুখী সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ডলারের জায়গায় অন্য কোনো মুদ্রা আসবে কি না-এ প্রশ্নের উত্তর হলো, এখনো তেমন কোনো স্থিতিশীল মুদ্রা নেই। উদাহরণস্বরূপ, ইউরো অনেক দেশের যৌথ মুদ্রা হলেও ইউরো অঞ্চল বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, চীনের মুদ্রা রেনমিন্বি বা ইউয়ান আন্তর্জাতিক বাজারে এখনো সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং স্বচ্ছভাবে বাণিজ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না। অর্থাৎ, রেনমিম্বি এখনো অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, যার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এখনো বেশি আস্থা রাখে ডলারে।
অনেক ছোট বা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয় এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রার মান অনেক বেশি অস্থিতিশীল থাকে। অর্থাৎ, তাদের মুদ্রার দাম বাজারে ওঠানামা করে অনেক দ্রুত। ফলে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ নেওয়ার সময় তাদের নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তাদের মুদ্রার মূল্য হঠাৎ কমে গেলে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে এতে সমস্যা হচ্ছে, যখন ডলারের মান ওঠানামা করে তখন ঐ দেশের অর্থনীতি সরাসরি প্রভাবিত হয়। যেমন, ডলারের মূল্য বেড়ে গেলে তাদের ঋণের বোঝা বেড়ে যায়, আমদানি ও রেমিট্যান্স খরচ বাড়ে আর অর্থনীতি কঠিন হয়ে পড়ে। সুতরাং ডলারের ওপর নির্ভরতা অনেক ছোট বা উন্নয়নশীল দেশের জন্য একধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম ইত্যাদি ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রাগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এগুলো কম্পিউটার কোডের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং কোনো কেন্দ্রীয় সরকার বা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অনেকের মনে হয়, ভবিষ্যতে এ ডিজিটাল মুদ্রাগুলো ডলারের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ এগুলো আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহার করা যায়, মাঝামাঝি কোনো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয় না এবং লেনদেন অনেক দ্রুত হয়। তবে এর বেশ কিছু বড় বাধা রয়েছে। প্রথমত, মুদ্রাগুলোর মূল্য খুব বেশি ওঠানামা করে, যা অনেক সময় বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। দ্বিতীয়ত, অনেক দেশ এখনো মুদ্রাগুলোর ব্যাপারে পরিষ্কার আইন বা নিয়ম তৈরি করেনি। তাই এগুলোকে বৈধ মুদ্রা হিসেবে পুরোপুরি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক দশকে ডলারের আধিপত্য কিছুটা কমে আসতে পারে। এর পেছনে কারণ প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতি ধীরে ধীরে বহু মুদ্রাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, শুধু ডলার নয়, ইউরো, রেনমিন্বি এবং অন্যান্য মুদ্রাও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং বিনিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বেড়ে চলেছে। তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চাইছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। তারা নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে ডলারের প্রভাব কমে। BRICS-এর মধ্যে ডলার নির্ভরতা কমানো নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে-ভারত স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যে জোর দিচ্ছে। ট্রাম্প শুল্কের হুমকি দিলেও ব্রাজিল, চীনসহ নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারে অটল থেকেছেন। বৈশ্বিকভাবে ডলারের আধিপত্য কিছুটা নড়বড়ে হলেও তা দ্রুত হারাবে না; ধীরে ধীরে বহুমুদ্রা ব্যবস্থার দিকে অগ্রগতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ আজ যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি, তার একটি বড় কারণ হলো ডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভ সংকট কিংবা মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যাগুলো একে অন্যের সঙ্গে জড়িত, আর এর কেন্দ্রে রয়েছে। ডলার। তা-ই শুধু স্বল্পমেয়াদি সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও সুসংহত পরিকল্পনা জরুরি। অনেক দেশ তাদের বাণিজ্য ও ঋণদানের ক্ষেত্রে ডলারের ওপর নির্ভরশীল, যা তাদের জন্য সুবিধাজনক, কারণ এটি একটি স্থিতিশীল ও গ্রহণযোগ্য মুদ্রা। তবে ভবিষ্যতে যখন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলো আরও দ্রুত ও ব্যাপক হবে, তখন ডলারের অবস্থান কী রকম হবে, সেটা দেখতে হবে খুব সতর্কতার সঙ্গে।
লেখক: ফিকামলি তত্ত্বের জনক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ভিন্ন কোনো মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলার এই ধারণাটিই হল ডি-ডলারাইজেশন। 'ডি-ডলারাইজেশন' শব্দটি নতুন মনে হতে পারে, তবে দেশগুলো কয়েক দশক ধরে ইউএস ডলারের উপর নির্ভরতা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। চীন, রাশিয়া, ব্রাজিলও এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যারা ডি-ডলারাইজেশনকে চাইছে। এই বছরের জানুয়ারিতে তারা ঘোষণা করেছিল, ইরান এবং রাশিয়া যৌথ ভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি হিসাবে স্বর্ণভিত্তিক একটি নতুন কারেন্সি চালু করবে। ডলারের প্রাধান্যকে সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হলেও আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য সর্বাধিক স্বীকৃত ও বহুলপ্রচলিত মুদ্রা হলো ইউএস ডলার। মূলত ১৯২০-এর দশকে ডলার, পাউন্ড ও স্টার্লিংকে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে। ব্রেটন উডস চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডলারের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, ১৯৪৪ সালের চুক্তিটি এমন একটি যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা ইউএস ডলারকে বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত করার অনুমতি দেয়।
কিন্তু ডলারের বিশ্বায়নের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী বাণিজ্যনীতি। এর বিপরীতে পালটা ব্যবস্থার দিকে হাঁটছে দেশটির অনেক বাণিজ্য অংশীদার, যার প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের অবস্থানে। আনাদোলুর এক প্রতিবেদন অনুসারে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি বৈশ্বিক প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এছাড়া বিকল্প বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ডি-ডলারাইজেশন বা ডলার-নির্ভরতা হ্রাসের চেষ্টা বাড়ছে।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) ইউএস ডলার সূচক ১১ শতাংশের বেশি কমে ৯৭-এ দাঁড়িয়েছে, যা ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স। গত ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাপকভাবে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের ঘোষণা দেন। এর পর থেকেই ডলার সূচক ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যে খণ্ডিত অবস্থা এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীদের ডলার থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করছে। এর বিপরীতে স্বর্ণ মজুতের পাশাপাশি ইউরো ও ইউয়ানের মতো বিকল্প মুদ্রার দিকে ঝুঁকছে তারা। ডলারের ওঠানামার সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজস্ব মুদ্রার মান পেগ বা স্থির করে রেখেছে চীন। এর ফলে ইউয়ানের বিনিময় হার অতিরিক্ত বাড়ে বা কমে না, যা রপ্তানিকারকদের জন্য অনুকূল। এতে ইউরোপসহ প্রধান বাজারে চীনা রপ্তানি মূল্য প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে। যে কারণে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশ চীনা পণ্য সস্তায় কিনতে পারে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জোট ব্রিকস সম্প্রতি ডলার-বহির্ভূত লেনদেনের উদ্যোগকে আরো গতিশীল করেছে। গবেষণা সংস্থা অফিশিয়াল মনিটারি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ফোরামের (ওএমএফআইএফ) এক জরিপ অনুসারে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যাংকগুলোর ১৬ শতাংশ ১২-২৪ মাসের মধ্যে ইউরোর মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। ৩২ শতাংশ বলেছে, তারা স্বর্ণের মজুত বাড়াতে চায়।বর্তমানে মার্কিন সরকারি ঋণ ৩৭ ট্রিলিয়ন বা ৩৭ লাখ কোটি ডলার, যা চলতি দশকের শেষ নাগাদ ৪৭ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে সরকারি কর রাজস্বের প্রায় ২০ শতাংশই এখন সুদ পরিশোধে ব্যয় ডলারের ওঠানামার সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজস্ব মুদ্রার মান পেগ বা স্থির করে রেখেছে চীন। এর ফলে ইউয়ানের বিনিময় হার অতিরিক্ত বাড়ে বা কমে না, যা রপ্তানিকারকদের জন্য অনুকূল। এতে ইউরোপসহ প্রধান বাজারে চীনা রপ্তানি মূল্য প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে হচ্ছে, যা মার্কিন বন্ডবাজার এবং ডলারের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গৃহীত হচ্ছে, যার মাধ্যমে ডলার-সমর্থিত স্টেবলকয়েন সারা বিশ্বে সহজলভ্য হবে। একে মার্কিন ঋণ ব্যবস্থাপনা সহজ করতে একটি দ্রুত ও বাস্তবমুখী সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ডলারের জায়গায় অন্য কোনো মুদ্রা আসবে কি না-এ প্রশ্নের উত্তর হলো, এখনো তেমন কোনো স্থিতিশীল মুদ্রা নেই। উদাহরণস্বরূপ, ইউরো অনেক দেশের যৌথ মুদ্রা হলেও ইউরো অঞ্চল বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, চীনের মুদ্রা রেনমিন্বি বা ইউয়ান আন্তর্জাতিক বাজারে এখনো সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং স্বচ্ছভাবে বাণিজ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না। অর্থাৎ, রেনমিম্বি এখনো অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, যার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এখনো বেশি আস্থা রাখে ডলারে।
অনেক ছোট বা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয় এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রার মান অনেক বেশি অস্থিতিশীল থাকে। অর্থাৎ, তাদের মুদ্রার দাম বাজারে ওঠানামা করে অনেক দ্রুত। ফলে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ নেওয়ার সময় তাদের নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তাদের মুদ্রার মূল্য হঠাৎ কমে গেলে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে এতে সমস্যা হচ্ছে, যখন ডলারের মান ওঠানামা করে তখন ঐ দেশের অর্থনীতি সরাসরি প্রভাবিত হয়। যেমন, ডলারের মূল্য বেড়ে গেলে তাদের ঋণের বোঝা বেড়ে যায়, আমদানি ও রেমিট্যান্স খরচ বাড়ে আর অর্থনীতি কঠিন হয়ে পড়ে। সুতরাং ডলারের ওপর নির্ভরতা অনেক ছোট বা উন্নয়নশীল দেশের জন্য একধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম ইত্যাদি ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রাগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এগুলো কম্পিউটার কোডের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং কোনো কেন্দ্রীয় সরকার বা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অনেকের মনে হয়, ভবিষ্যতে এ ডিজিটাল মুদ্রাগুলো ডলারের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ এগুলো আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহার করা যায়, মাঝামাঝি কোনো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয় না এবং লেনদেন অনেক দ্রুত হয়। তবে এর বেশ কিছু বড় বাধা রয়েছে। প্রথমত, মুদ্রাগুলোর মূল্য খুব বেশি ওঠানামা করে, যা অনেক সময় বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। দ্বিতীয়ত, অনেক দেশ এখনো মুদ্রাগুলোর ব্যাপারে পরিষ্কার আইন বা নিয়ম তৈরি করেনি। তাই এগুলোকে বৈধ মুদ্রা হিসেবে পুরোপুরি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক দশকে ডলারের আধিপত্য কিছুটা কমে আসতে পারে। এর পেছনে কারণ প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতি ধীরে ধীরে বহু মুদ্রাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, শুধু ডলার নয়, ইউরো, রেনমিন্বি এবং অন্যান্য মুদ্রাও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং বিনিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বেড়ে চলেছে। তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চাইছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। তারা নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে ডলারের প্রভাব কমে। BRICS-এর মধ্যে ডলার নির্ভরতা কমানো নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে-ভারত স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যে জোর দিচ্ছে। ট্রাম্প শুল্কের হুমকি দিলেও ব্রাজিল, চীনসহ নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারে অটল থেকেছেন। বৈশ্বিকভাবে ডলারের আধিপত্য কিছুটা নড়বড়ে হলেও তা দ্রুত হারাবে না; ধীরে ধীরে বহুমুদ্রা ব্যবস্থার দিকে অগ্রগতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ আজ যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি, তার একটি বড় কারণ হলো ডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভ সংকট কিংবা মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যাগুলো একে অন্যের সঙ্গে জড়িত, আর এর কেন্দ্রে রয়েছে। ডলার। তা-ই শুধু স্বল্পমেয়াদি সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও সুসংহত পরিকল্পনা জরুরি। অনেক দেশ তাদের বাণিজ্য ও ঋণদানের ক্ষেত্রে ডলারের ওপর নির্ভরশীল, যা তাদের জন্য সুবিধাজনক, কারণ এটি একটি স্থিতিশীল ও গ্রহণযোগ্য মুদ্রা। তবে ভবিষ্যতে যখন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলো আরও দ্রুত ও ব্যাপক হবে, তখন ডলারের অবস্থান কী রকম হবে, সেটা দেখতে হবে খুব সতর্কতার সঙ্গে।
লেখক: ফিকামলি তত্ত্বের জনক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক